একাদশী কি
একাদশী হলো ভগবান বিষ্ণুর তিথি রূপ মূর্তি | নিজ কৰ্ম্মদোষে পাপচারী মানবগনকে যমদূতরা নরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল , ফলস্বরুপ তারা যন্ত্রণা ভোগ এবং উচ্চস্বরে কান্না করছিল তখন যম-মন্দিরে গিয়ে পুরুষোত্তম ভগবান দক্ষিণদিক থেকে আসা সেই ক্রন্দনধ্বনি শ্রবণ করে | সেই স্থানে শ্রীকৃষ্ণ উপস্থিত হইলেন, তখন মর্ত্যবাসী মানবগণকে যন্ত্রণায় পীড়িত দেখে তার হৃদয় দয়ার সঞ্চার হলো তৎক্ষণাৎ ভগবান শ্রীবিষ্ণু একাদশী তিথিরূপ মূর্তি ধারন করলেন | সেই পাপিগণকে তিনি একাদশীব্রত আচরণ করাইলেন এবং তখনই তাহারা পাপ-মুক্ত হইয়া পরমধাম বৈকুণ্ঠে গমন করিলেন |
একাদশী কিভাবে সৃষ্টি হল
শ্রীপদ্মপুরাণে দৃষ্ট হয়, যথা—এক সময় জৈমিনি ঋষি নিজ গুরুদেব মহর্ষি শ্রীব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, —
কস্মাদেকাদশী জাতা তস্যাঃ কো বা বিধি দ্বিজ ।
কদা বা ক্রিয়তে কিম্বা ফলং কিম্বা বদস্ব মে।।
কা বা পূজ্যতমা তত্র দেবতা সদগুণার্ণবঃ।
অকুৰ্ব্বতঃ স্যাৎ কো দোষ এতন্মে বক্তুমর্হসি।।
(শ্রীপদ্মপুরাণ-ক্রিয়াযোগসার, ১৪ অধ্যায়)
অর্থাৎ, জৈমিনি কহিলেন—হে গুরুদেব! একাদশী-দেবী কখন ও কাঁহার নিকট হইতে উৎপন্না হইলেন, তাঁহার উপবাসের বিধি কি, কখন বা এই ব্রত করিতে হয় এবং উহার ফলই বা কি, তাহা বর্ণন করুন; আর ঐ ব্রতের পূজ্যতম সদ্গুণসম্পন্ন দেবতাই বা কে এবং এই ব্রতাচরণ না করিলে দোষই বা কি হয়, সে-সকল বিষয়ও একমাত্র আপনিই বলিতে সমর্থ, কৃপাপূর্ব্বক আমাকে বলুন ।
জৈমিনির প্রশ্নের উত্তরে শ্রীব্যাসদেব আনন্দভরে ভগবৎকথা বর্ণন করিতে লাগিলেন— বিশ্বসৃষ্টির প্রারম্ভে স্বয়ং ভগবান্ প্রপঞ্চাত্মক সংসারে স্থাবর-জঙ্গম সৃষ্টি করিয়া মর্তলোকবাসী মানবগণের শাসন নিমিত্ত একটি পাপ-পুরুষ (পাপমূর্তি) নির্ম্মাণ করিলেন। সেই পাপমূর্ত্তির অঙ্গসকল পাপদ্বারাই নিৰ্ম্মিত হইল অর্থাৎ ব্রহ্মহত্যা-তাহার মস্তক, মদ্যপান—চক্ষুদ্বয়, স্বর্ণ-অপহরণ—মুখ, গুরুপত্নী (বিমাতা)-গমন—কর্ণদ্বয়, স্ত্রীহত্যা— নাসিকাদ্বয়, গো-হত্যা-পাপ – বাহুযুগল, ধন-অপহরণ—গ্রীবা, ভ্রূণহত্যা (গর্ভস্থ শিশুবধ)—গলদেশ, পরস্ত্রী-গমন–বক্ষদেশ, আত্মীয়-স্বজনবধ- উদর, শরণাগত-বধ—নাভিদেশ, আত্মশ্লাঘা—কটিদেশ, গুরুনিন্দা- ঊরুদ্বয়, কন্যা-বিক্রয়—শিশ্ন, গুপ্তকথা-প্রকাশ—মলদ্বার, পিতৃহত্যা- চরণদ্বয়, উপপাতক সকল—তাহার রোমাবলী; এইভাবে সমস্ত পাপদ্বারা বিশাল দেহের এক ভয়ঙ্কর পাপপুরুষ নির্ম্মিত হইল।
নিজসৃষ্ট মহাকায় পাপপুরুষের এইপ্রকার ভয়ঙ্কর মূর্তি দর্শন করিয়া জীবদুঃখ-মোচনকারী ভগবান্ চিন্তা করিতে লাগিলেন। অতঃপর ভগবান্ বিষ্ণু গরুড়ে আরোহণ করিয়া যম-মন্দিরে গমন করিলেন। যমরাজ তাঁহাকে উপযুক্ত স্বর্ণসিংহাসনে উপবেশন করাইয়া পাদ্যাদি-দ্বারা তাঁহার যথাবিধি পূজা করিলেন।
যমরাজের সহিত কথোপকথন-কালে পুরুষোত্তম ভগবান্ দক্ষিণদিকে ক্রন্দনধ্বনি শ্রবণে উহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। যমরাজ উত্তরে বলিলেন——হে দেব! পাতকী মৰ্ত্ত-জীবগণ নিজ কৰ্ম্মদোষে অত্যন্ত দুঃখজনক নরক ভোগ করিতেছে।’ইহা শ্রবণ করিয়া শ্রীকৃষ্ণ সহসা তথায় উপস্থিত হইলেন। সেই মর্ত্যবাসী পাপাচারী মানবগণকে যন্ত্রণায় পীড়িত দর্শন করতঃ তাঁহার হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হইল। তিনি সৰ্ব্বশক্তিমান, তাই নিজে চিন্তা করিতে লাগিলেন—‘আমিই এই সকল প্রজা সৃষ্টি করিয়াছি, আর আমি বর্ত্তমান থাকিতে ইহারা নিজ কর্ম্মদোষে অত্যন্ত দুঃখদায়ক এই নরক-যন্ত্রণাভোগ করিতেছে।
এই মনে করিয়া তিনি নিজেই একাদশী-তিথিরূপা মূর্তি ধারণ করিলেন। প্রমাণ-স্বরূপ নিম্নলিখিত শাস্ত্রবাক্য উল্লেখ করিতেছি—
এতচ্চান্যচ্চ বিপ্ৰর্ষে বিচিন্ত্য করুণাময়ঃ।
বভূব সহসা তত্র স্বয়মেকাদশীতিথিঃ।।
ততস্তান্ পাপিনঃ সৰ্ব্বান করয়ামাস ততম।
তে চ সর্ব্বে পরং ধাম যযুৰ্গলিতকল্মষাঃ।।
তস্মাদেকাদশীং মূৰ্ত্তিং বিদ্ধি পরমাত্মনঃ।
সমস্ত সুকৃত-শ্রেষ্ঠাং ব্রতানামুত্তমঃ দ্বিজ।।
অর্থাৎ করুণাময় ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ চিন্তা করিয়া সেই স্থানেই সহসা নিজে একাদশী তিথিরূপ মূর্তিধারণ করতঃ আবির্ভূত হইলেন। তাহার পর সেইসকল পাপিগণকে তিনি একাদশীব্রত আচরণ করাইলেন।
তাহারা তৎক্ষণাৎ পাপ-মুক্ত হইয়া পরমধাম বৈকুণ্ঠে গমন করিলেন। সুতরাং হে বৎস জৈমিনি! তুমি একাদশী তিথিকে পরমাত্মা বিষ্ণুর মূর্ত্তি বলিয়াই জানিবে। সমস্ত সুকর্ম্মের শ্রেষ্ঠ ও ব্রত-সকলের উত্তম এই একাদশী ত্রিভুবন পবিত্র করিয়া থাকেন ।
এইরূপ কিছুকাল অতীত হইবার পর ভগবৎ-সৃষ্ট সেই পাপপুরুষ বিষ্ণু-সমীপে গমন-পূর্ব্বক বদ্ধাঞ্জলি হইয়া সকাতর প্রার্থনা জানাইল,
“হে ভগবান্ বিষ্ণু ! আমি আপনার সৃষ্ট প্রজা, আমাকে আশ্রয়কারী (পাপাচারী) জনগণের কর্ম্মানুযায়ী তাহাদিগকে দুঃখ-দানই আমার কার্য্য ছিল। কিন্তু সম্প্রতি একাদশী-প্রভাবে আমি ক্ষয়প্রাপ্ত হইতেছি, কারণ ঐ ব্রতের ফলে প্রায় সকলেই বৈকুণ্ঠবাসী হইতে চলিল। আমি এখন কাহাকে আশ্রয় করিয়া বর্ত্তমান থাকিব? আর সকল জীব বৈকুণ্ঠে চলিয়া গেলে আপনি কাহার সহিত মর্ত্যে ক্রীড়া করিবেন? অতএব যদি বিশ্বসৃষ্টিরূপ কৌতুকাগারে আপনার ক্রীড়া করিবার আকাঙ্ক্ষা থাকে, তবে হে কেশব! একাদশী তিথির ভয় হইতে আমায় রক্ষা করুন। হে কৈটভনাশন! আমি এক একাদশীর ভয়ে পলায়ন করিয়া সমস্ত মনুষ্য, পশু-পক্ষী, কীট, জন্তু, পৰ্ব্বত, বৃক্ষ, জল, স্থল, নদী, সমুদ্র, বন, প্রান্তর, স্বর্গ-মর্ত্য, পাতাল, দেবতা ও গন্ধর্ব্ব ইহাদের সকলকে আশ্রয় করিয়াছি, কিন্তু কোথাও নির্ভয় স্থান পাই নাই দেখিয়া আপনার শরণাপন্ন হইয়াছি। হে দেবদেব ! আপনার সৃষ্ট অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ড-মধ্যে একাদশীই প্রাধান্য লাভ করিয়াছে, সেই জন্য আমি কোথাও আশ্রয় প্রাপ্ত হইলাম না। আপনি কৃপাপূর্ব্বক আমায় একটি নির্ভয় স্থান দান করুন ।”
তখন ক্লেশনাশন শ্রীভগবান্ হাস্য-সহকারে সেই পাপপুরুষকে বলিতে লাগিলেন— “ওহে পাপপুরুষ! তুমি দুঃখ করিও না । ত্রিভুবন-পবিত্রকারিণী একাদশী তিথি আবির্ভূত হইলে তুমি অন্ন ও রবি-শস্য প্রভৃতিকে আশ্রয় করিয়া অবস্থান করিবে, আমার মূর্ত্তি একাদশী তিথি তোমায় বধ করিবে না।’ এই জন্যই একাদশীতে অন্ন ও রবিশস্য আহার করা হয় না।”
ছাব্বিশটি (২৬ ) একাদশীর বিবরন এবং তালিকা
একাদশী ছাব্বিশটি (২৬ ) প্রকারের হয় এবং এক বছরে মোট ছাব্বিশটি একাদশী পলন করার হয়। বছরের প্রথম কামদা একাদশী দিয়ে শুরু হয় এবং শেষ হয় পাপমোচনী একাদশী মধ্যে দিয়ে। প্রতিটি একাদশীর রয়েছে আলাদা মাহাত্ম্য এবং কারন । জানুন প্রতিটি একাদশীর সর্ম্পকে :